হোয়াইট হাউসে প্রকাশ্যে এলো ট্রাম্প-জেলেনস্কির তর্ক, কোন দিকে যাবে ইউক্রেন সঙ্কট?

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প হাসিমুখেই অপেক্ষায় ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য। কিন্তু কেউ জানত না এই হাসি কয়েক মিনিট পরেই উধাও হবে। নিমেষেই শুরু হয়ে যাবে ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাকবিতন্ডা। ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির প্রকাশ্য বিতণ্ডার পর বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু অন্যদিকে সকলের মুখে শোনা গেছে শান্তির বার্তা। এমনকি ইউক্রেনের পাশে থাকা হবে সেই বার্তাও শোনা গেছে। ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগ্‌যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য কতটা ভালো? ইউক্রেনপন্থী অনেকেই দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন নীতিতে অনেক বদল দেখা গেছে।

এমনকি ইউক্রেনকে যেসব সামরিক সাহায্য করা হয়েছিল তাও কাটছাঁট করা হয়। ট্রাম্প সরকারের আধিকারিকরা ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের আপত্তি উড়িয়ে সৌদি আরবে যুদ্ধবিরতির জন্য রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এমনকি আমেরিকা রীতিমতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকেই দায়ী করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, খনিজ বণ্টন চুক্তি- এই দুইই ছিল ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের মূল বিষয়। ইউক্রেন সম্প্রতি রাজি হয়েছে আমেরিকার সঙ্গে খনিজ বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার বিনিময়ে চলতি মাসের গোড়ায় ইউক্রেনের খনিজে আমেরিকার অগ্রাধিকারের চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জেলেনস্কি। পরে অবশ্য এই চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করতে রাজি হয়ে যান।

শুধুমাত্র ট্রাম্প প্রশাসন নয় অনেকেরই ধারণা ছিল যে হোয়াইট হাউসের বৈঠকেই ওই চুক্তিপত্রে সাক্ষর করবেন ইউক্রেন প্রধান কিন্তু বাস্তবে তা হল না। দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকে রীতিমতো বদলে গেল দুই দেশের সমীকরণ। খনিজ বণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনরকম আলোচনা এগোলো না, বরং ভেস্তে গেল সবকিছুই। নেপথ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ। ট্রাম্প- জেলেনস্কির বাগ্‌‌বিতণ্ডা চলল টানা প্রায় ৪০ মিনিট। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সেরও। সংবাদমাধ্যমের সামনেও প্রকাশ পেল এই তর্কবিতর্ক।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ এবং তারপর চলতে থাকা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই দায়ী করেন ভান্স। সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে কড়া কড়া কথা বলে গিয়েছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তারপর পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করলেন। জো বাইডেন এর পথে হেটে কোনভাবেই শান্তি কায়েম করা যায় না। বাইডেন জমানায় ইউক্রেন আমেরিকার থেকে সামরিক সাহায্য পেয়েছিল। বাইডেনের পুতিন বিরোধিতাও ইউক্রেনের পক্ষে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বহু নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে। তার পরিবর্তনশীল নীতি বিপদ বাড়িয়েছে ইউক্রেনের জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সমঝোতার প্রস্তাব দিলেও তাতে একেবারে রাজি হলেন না জ়েলেনস্কি।

আরও পড়ুন: আমেরিকায় বাতিল জন্মসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্বের অধিকার, বড়সড় সিদ্ধান্ত নিল ট্রাম্প

বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। কারণ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে আমেরিকার কাছ থেকে। তবে পাল্টা জবাবে ইউক্রেন প্রধান বলেছেন এখানে কৃতজ্ঞতার কোন প্রশ্ন আসে না। কারণ তাদের দেশ এখন জ্বলছে, মারা গেছে বহু মানুষ। তাই কোনোভাবেই সমঝোতার পথে হাঁটবে না ইউক্রেন। জেলেনস্কির মতে আমেরিকার সাহায্য করছে পরোক্ষভাবে রাশিয়াকেই। শান্তি চুক্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। তার জন্য কিছু ‘আপস’ও করতে হবে, তবে তা খুব বেশি নয়। তার পরেই যোগ করেন, যদি ইউক্রেন কোনরকম চুক্তিবদ্ধ না হয় তাহলে পাশ থেকে সরে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প, ভান্স এবং জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের জেরে সফল হয়নি এই বৈঠক, এমনকি বাতিল হয়ে যায় যৌথ সাংবাদিক বৈঠকও। এই উত্তপ্ত বৈঠকের পরে কি অপেক্ষা করছে ইউক্রেনের জন্য? এর পরেই ইউক্রেনকে নিশানা করে ট্রাম্পের মন্তব্য, আমেরিকার কোনও ভূমিকা থাকলে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শান্তি প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন না। ইউক্রেন প্রধান ওভাল অফিসে বসে আমেরিকাকে অসম্মান করেছেন বলে জানিয়ে ট্রাম্প লিখেছেন, যদি তিনি শান্তির জন্য প্রস্তুত থাকেন তাহলে ফিরে আসতে পারেন হোয়াইট হাউসে। হোয়াইট হাউসের এই কান্ড কোথায় নিয়ে যাবে দুই রাষ্ট্রনেতার সম্পর্ককে? আদৌ কি কোনদিনও মেরামত হবে এই সম্পর্ক?

বিশ্ব কূটনৈতিক মহল বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত। জেলেনস্কি আশাবাদী তাদের সম্পর্ক অবশ্যই ভালো হবে কিন্তু তিনি ক্ষমা চাইতে নারাজ। আবার তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, এই ধরনের বাদানুবাদ উভয় পক্ষের জন্যই খারাপ। ট্রাম্প যদি ইউক্রেনকে সাহায্য না-করেন, তবে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানো ইউক্রেনের পক্ষে সত্যি মুশকিল। তবে সম্পর্কের উন্নতি হবে এই বিষয়ে তিনি আশা রাখছেন। এখানে সম্পর্ক শুধুমাত্র দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে নয়, সম্পর্ক হল দুটি দেশের মানুষের।

আমেরিকা এবং ইউক্রেনের মধ্যে বিশেষ খনিজ চুক্তি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছিল। চুক্তির প্রস্তাব ইউক্রেন প্রধান দিলেও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে কিছু বিরল খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। সেই খনির দিকে আমেরিকার নজর রয়েছে। চুক্তি অনুসারে সেই খনিজ পদার্থ বিনা অনুমতিতেই ব্যবহার করার সুযোগ ছিল আমেরিকার কাছে। ট্রাম্প সেই কারণেই এই চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমেরিকাকে বিরল খনিজ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা আরো মজবুত করতে চেয়েছিল ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান। তবে শেষমেষ ভেস্তে গেল এই খনির চুক্তি।

আরও পড়ুন: জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির সামনে শুয়ে আছেন তরুণ পর্যটক, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হল ভিডিও

বৈঠক সম্পন্ন হওয়ার পরে মুখ খুলেছেন একাধিক ইউরোপের রাষ্ট্রনেতারা। তারা পাশে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সমস্ত ইউরোপের দেশগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তারাই কিন্তু অবশেষে পাশে দাঁড়াচ্ছে ইউক্রেনের। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ট্রাম্প আসায় বেশ আতঙ্কিত ইউরোপের এই দেশগুলো। এমনকি নিজের পোশাক নিয়েও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দপ্তরে এসে তিনি এই ধরনের পোশাক কেন পরলেন? পোশাক নিয়েও তাকে নানারকম ব্যঙ্গ করা হয়। যার উত্তর তিনি কঠোরভাবেই দিয়েছেন।

ট্রাম্প- জেলেনস্কি বাদানুবাদ এবং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ঘটনায় উল্লসিত মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ওই ঘটনার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকেই। ট্রাম্পের সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধের পরের দিনই জেলেনস্কি জানান, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই মুহূর্তেই তিনি যুদ্ধবিরতি করবেন না। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া ইউক্রেনের জন্য বিপজ্জনক। সমাজমাধ্যমের কাছে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর কাছে তিনি কৃতজ্ঞ।

আমেরিকার সঙ্গে না-হওয়া খনিজ চুক্তি নিয়েও মুখ খুলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। খনিজ চুক্তি করতে তারা প্রস্তুত কিন্তু সেটাই হবে তাদের নিরাপত্তার প্রথম ধাপ। আপাতভাবে অনেকেই বিষয়টি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সুর নরমের চেষ্টা বলে মনে করছেন। ট্রাম্প জেলেনস্কি বাকবিতন্ডা কোন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধকে? অনেকের মতে, ট্রাম্প অর্থাৎ আমেরিকার মতো দেশ যদি ইউক্রেনের বিপক্ষে চলে যায় তাতে চাপে পড়তে পারেন ইউক্রেন প্রধান। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে গেলে ইউক্রেনের প্রয়োজন সামরিক সাহায্য। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় না রাখলে সেই সাহায্য তারা পাবে না। সেই সাহায্য বন্ধ হলে সমস্যায় পড়তে পারে ইউক্রেন। রাশিয়ার সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা ইউক্রেনের পক্ষে সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *